হযরত আলি (রা.) (পাঠ ৫)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম শিক্ষা আদর্শ জীবনচরিত | - | NCTB BOOK
73
73

পরিচয়

হযরত আলি (রা.) ছিলেন রাসুল (স.)-এর চাচাতো ভাই। তিনি ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবু তালিব, মাতার নাম ফাতিমা বিনতে আসাদ। তিনি ছোটদের মধ্যে প্রথম মুসলমান। তিনি ১০ বছর বয়সে মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি 'আশারা-ই-মুবাশশারার' (জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবি)-এর একজন এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা। ছোটকাল থেকেই জ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাই তিনি সর্বদা রাসুল (স.)-এর সাথে সাথে থাকতেন। রাসুল (স.)-এর প্রতি তাঁর ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল অসীম। রাসুল (স.) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর অতি আদরের কন্যা ফাতিমাকে হযরত আলি (রা.)-এর সাথে বিবাহ দেন। হযরত আলি (রা.) খুব নির্ভিক ও সাহসী ছিলেন। রাসুল (স.) হিজরতের সময় তাঁকে তাঁর বিছানায় রেখে যান। রাসুল (স.)-এর কাছে আমানত রাখা সম্পদ মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। এতে তাঁর জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এরপরও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

বীরত্ব ও জ্ঞানসাধনা

হযরত আলি (রা.) ছিলেন একজন অসাধারণ বীরযোদ্ধা। তাঁর বীরত্বের কারণে বদরের যুদ্ধে 'জুলফিকার' নামক তরবারি উপহার পান। আর খায়বার যুদ্ধে 'কামুস' দুর্গ বিজয়ের পর রাসুল (স.) তাঁকে 'আসাদুল্লাহ' (আল্লাহর সিংহ) উপাধি দেন। তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের সময় মুসলিম বাহিনীর পতাকা বহনকারী ছিলেন।

জ্ঞান সাধক হযরত আলি (রা.) ছিলেন জ্ঞানপিপাসুদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তাঁর জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিল। কুরআনের তাফসির, হাদিসের বিশ্লেষণ এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। আরবি ভাষার ব্যাকরণ রচনায় তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপারে মহানবি (স.) বলেছেন, "আমি জ্ঞানের শহর, আর আলি (রা.) তার দরজা।" (মুস্তাদরাক হাকিম)। হযরত আলি (রা.)-এর রচিত 'দেওয়ানে আলি' (আলির কাব্য সংকলন) আরবি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি তাঁর শাসনামলে মসজিদে জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করেন।

খলিফা নির্বাচন

৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হযরত উসমান (রা.) শাহাদতবরণ করেন। এরপর মুসলমানদের মতামতের ভিত্তিতে হযরত আলি (রা.) মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন। অসাধারণ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে দৃঢ়তার সাথে এগুলো সমাধা করেন।

হযরত আলি (রা.)-এর রাষ্ট্র পরিচালনা

তখন মুসলমানগণ চরম উপদলীয় কোন্দলে লিপ্ত হওয়ায় ইসলামের ইতিহাসের চরম সংকটকাল চলছিল। তিনি শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়া আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি রাজনৈতিক জোট (Coalition) গঠন করেন এবং প্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি (Nepotism) সম্পূর্ণভাবে পরিহার করেন। তিনি অভিজাত ভূমি মালিকদের নিকট থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করেন এবং আদায়কৃত কর ও যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুসলিম নাগরিকগণের মধ্যে সমভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যেহেতু তখন প্রায় সকল মুসলমানই বেদুঈন ও কৃষক ছিলেন সে কারণে তিনি ভূমি ও কৃষি উন্নয়নের বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন।

হযরত আলি (রা.)-এর প্রশাসনিক আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে মিসরের গভর্নর মালিক আল-আশতারের কাছে প্রেরিত নির্দেশনামূলক একটি চিঠিতে, তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, "তুমি তোমার প্রজাদের জন্য তোমার অন্তকরণে ক্ষমা, ভালবাসা ও দয়া প্রবিষ্ট কর। তাদেরকে সহজে শিকারযোগ্য মনে করে তাদের সম্মুখে পেটুক জন্তুর মতো হয়ো না। কেননা তারা দুইধরনের হয়তো তারা তোমার ধর্মীয় ভাই নয়তো তারা সৃষ্টিগতভাবে তোমার সমান। তারা অসতর্কভাবে ভুল করতে পারে, তাদের অদক্ষতা থাকতে পারে, তাদের দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা ভুলবশত (মন্দকাজ) সংঘঠিত হতে পারে। সুতরাং তাদেরকে সেভাবেই ক্ষমা কর যেভাবে তুমি আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা প্রত্যাশা কর। কেননা, তুমি তাদের উপরে এবং যে তোমাকে নিযুক্ত করেছে সে তোমার উপরে, আর আল্লাহ তার উপরে যে তোমাকে নিযুক্ত করেছে।

তুমি তাদের (প্রজাদের) চাহিদাগুলো পূরণ করবে আল্লাহ তাই প্রত্যাশা করেন এবং তিনি তাদের দ্বারা তোমাকে পরীক্ষা করছেন।"

উল্লেখ্য যে, উপর্যুক্ত নির্দেশনাকে ইতিহাসে ইসলামি শাসনের আদর্শ সংবিধান (Ideal Constitution of Islamic Governance) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

জীবনযাপন

হযরত আলি (রা.) ছিলেন সহজ-সরল ও আত্মত্যাগের সুমহান আদর্শ। ছোটকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। নিজের খাদ্য নিজেই যোগাড় করতেন। কখনো কখনো অনাহারে থাকতেন। তিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন। জীর্ণ কুঠিতে বসবাস করতেন। ধনী-দরিদ্র সকলের সাথে মিলেমিশে চলতেন। খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরও এসব গুণাবলি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।

তিনি প্রায় ৬ বছর খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। অবশেষে ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে মুলজাম নামক এক পথভ্রষ্ট খারেজির হাতে শাহাদতবরণ করেন। তখন তিনি নামাযরত অবস্থায় ছিলেন। রাসুল (স.) তাঁর ব্যাপারে বলেছেন- 'সে [আলি (রা.)] প্রত্যেক মুমিনের বন্ধু।' (তিরমিযি)

বাড়ির কাজ: শিক্ষার্থীরা জ্ঞানসাধনায় হযরত আলি (রা.)-এর অবদান সম্পর্কে ১০টি বাক্যের একটি অনুচ্ছেদ তৈরি করবে।
Content added By
Promotion